মাস্টার মুহাম্মদুল্লাহ
১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগ, ন্যাপসহ পাঁচ রাজনৈতিক দলের বৈঠকে “জাতীয় উপদেষ্টাা কমিটি” গঠিত হয়। যা ‘সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিসদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ৮ সদস্য বিশিষ্ট এ পরামর্শ কমিটির সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক তাজ উদ্দিন আহমদ। আন্তর্জাতিক শক্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুক‚লে আনতে এ কমিটি সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে।
যুদ্ধে পুরো সময় মাওলানা ভাসানী ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সহায়ক ভ‚মিকা রাখতে জাতিসংঘ, চীন, রাশিয়াসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে তার বার্তা প্রেরণের পাশাপাশি তার আন্তর্জাতিক প্রভাবকে সর্বত্মক ব্যবহার করেছিলেন। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের মহা নায়ক যদি ভাসানী হোন, তবে স্বার্থহানী হবে ভারতের। কারণ ভাসানী হক কথা বলতে কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সেই জন্যই ১৬ ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়া সত্তে¡ও মাওলানা ভাসানী স্বাধীন দেশে পা রাখলে পাকিস্তানে কারাবন্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরেন ১২ দিন পর। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারী ঢাকায় ফিরে তিনি সর্বপ্রথম যে দাবিটি তুলেন তা হলো, ‘বাংলাদেশের ভ‚খন্ড থেকে ভারতীয় সেনা বাহিনী অপসারণ।’
মুক্তি যুদ্ধে আলেম সমাজের ভ‚মিকা প্রসঙ্গে ‘ড. তারেক মুহাম্মদ তওফীকুর রহমান’ তার বিশ্লেষণে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছেনে। তিনি সেই সময়ে ইসলামপন্থীদল বা সামাজিক সংগঠনগুলোকে তাদের ঝোঁক বা অনুসৃত ধারা অনুসারে ভাগ করেছেন। তিনি তার “বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজের ভ‚মিকা ও প্রভাব” গ্রন্থের ২২ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ‘সেই সময় বাংলাদেশের আলেম সমাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা ছয় (৬) ধারায় বিভক্ত ছিলেন।
১. বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম।
২. বিভিন্ন সাধারণ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেম।
৩. সরকারী-আধা সরকারী মাদরাসাগুলোর শিক্ষক ও আলেম।
৪. কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক ও আলেম।
৫. বিভিন্ন খানকাহ, সিলসিলা ও পীর-মুরিদী সংশ্লিষ্ট আলেম।
৬. ইমাম, ময়াজ্জিন ও ব্যক্তি পর্যায়ের আলেম।
এ ধারাগুলোর মধ্যে আলেম সমাজের এক বিশাল অংশ মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় অংশ অবস্থা নেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- আল্লামা হাফেজ্জি হুজুর রহ., আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ., আল্লামা কাজী মুহতাসিম বিল্লাহ রহ., আল্লামা মুফতি নুরুল্লাহ রহ., আল্লামা এমদাদুল্লাহ আড়াই হাজারী রহ., আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী প্রমূখ। এদের মধ্যে অনেকেই রণাঙ্গণে সক্রিয় মুক্তি যুদ্ধে অশ নেন। অনেকেই মুক্তি যুদ্ধে বরিত্বপূর্ণ ভ‚মিকার খেতার প্রাপ্ত হন। সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান নেন। মাওলানা শাকের হুসাইন শিবলী তার “আলেম মুক্তি যুদ্ধার খোঁজে” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মাওলানা এমদাদুল্লাহ আড়াই হাজারী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কী করবেন এ ব্যাপারে দেশবরেণ্য আলেম মাওলানা হাফেজ্জী হুজুর রহ. কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হলো জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ” পাকিস্তানীরা জালেম আর এ দেশের বাঙ্গালীরা মাজলুম। পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার করেছে। সুতরাং তারা জালেম। জুলুম আর ইসলাম এক হতে পারে না। তুমি যদি মুসলমান হও, তবে পাকিস্তানীদের পক্ষে যাও কিভাবে? এটাতো জালেমের বিরূদ্ধে মজলুমের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পটিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা আল্লামা দানেশকে পাকিস্তনী হানাদার বাহিনী হত্যা করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন নিশ্চিত হয়, পটিয়া মাদ্রাসার আলেমরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে, তখনই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পটিয়া মাদ্রাসার উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা বর্ষন শুরু করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর এই বোমা বর্ষণে পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশ ও ক্বারী জেবুল হাসান সহ অনেকেই শহীদ হোন।
(তথ্যসূত্র : বেলাল মোহাম্মদ : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, পৃষ্ঠা-৫৪-৫৫ ও ১০২)
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা মুখলেছুর রহমানের কাছে কুমিল্লার চান্দিনা থানা পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় এবং ১৩৯৫ জন পাক আর্মি আত্ম সমর্পন করে। ১৯৭১ সালে মাওলানা মুখলেছুর রহমান চাঁদপুরের কচুয়া মাদরাসায় তাফসীরে জালালাইন পড়তেন। মাওলানা মুখলেছুর রহমান এর মুক্তিযুদ্ধা সার্টিাফকেট সনদ ক্রমিক নং ২০২০৬। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানার জয়দা গ্রামের মাওলানা বাড়ীর সবাই মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন। (তথ্যসূত্র : আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড-৬১)
২০০৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে “স্বাধীন বাংলা বেতারে আলেম মুক্তিযুদ্ধা” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধা মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ও মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং মানুষকে ইসলামের আলোকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতেন।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা প্রখ্যাত আলেম আওলাদের রাসুল সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী রহ. এর ভ‚মিকা অবিস্মরণীয়। পাকিস্তানী বাহিনী এ দেশের নিরীহ মানুষের উপর বর্বরোচিত হামলা করলে তিনি তাৎক্ষণিক জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মিটিং আহŸান করে এর তীব্র নিন্দা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর জোড়ালো বক্তব্য পেশ করেন। তারপর পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করলে তিনি তার প্রতিবাদে কয়েক লাখ লোক নিয়ে দিল্লিতে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবী জানিয়েছিলেন।
১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিলো জালিমের বিরূদ্ধে মজলুমের। পাকিস্তানিরা ছিল জালিম আর এদেশের নিরীহ মানুষ ছিলো মজলুম। আর মজলুমকে সাহায্য করা, তাদের পক্ষে কথা বলা এটাই মনুষ্যত্বের পরিচয় এবং ঈমানী দায়িত্ব। আর সে ঈমানী দায়িত্ব পালনেই আলেম সমাজ এদেশের মানুষকে পাকিস্তানী জালিম শাসকের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। রাজপথে যুদ্ধ করেছিলেন। তাই অসংখ্য উলামাদের রক্তের কালিতে আঁকা হয়েছে বিশ^ভ‚খন্ডের বুকে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র।
লেখক : শিক্ষক, জামেয়া ইমামবাড়ী