প্রেক্ষাপট
ইংরেজদের দুইশত বছরের অপশাসনে এদেশে ইসলামের বাতি নিভু নিভু করছিল। আলেম-উলামা তৈরির কেন্দ্র মাদ্রাসা-মসজিদগুলো শেষ করে দিয়েছিল ইংরেজরা। ফলে গোটাদেশে আলেম-উলামার সংখ্যা নেহায়াত কম ছিল। হবিগঞ্জ অঞ্চলে মাও. আসাদুল্লাহ, মাও. আমির আলীসহ মাত্র কয়েকজন আলেমের নাম পাওয়া যায়। অবশ্য ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর কিছু কিছু আলেম তৈরি হওয়া শুরু হয়। এছাড়া এতদাঞ্চলে দ্বীনী কোনো প্রতিষ্ঠানও ছিলনা।
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকাল
এহেন পরিস্থিতিতে একটি দ্বীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এলাকার মুরুব্বিগণ। তাদের অন্যতম হলেন মৌলভী ফিরুজ মিয়া চৌধুরী রহ.। তিনি একজন সহজ-সরল মুখলিছ বান্দা ছিলেন। তিনি আরো কয়েকজন মুরুব্বিদের নিয়ে হাজী মফিজ উদ্দীন চৌধুরীর সাহেবের কাছে গিয়ে মিনতি করে মাদ্রাসার জন্য জায়গা চান। হাজী সাহেবের কোনো সন্তানাদি ছিল না। তখন মাদ্রাসার বর্তমান জায়গাটি নিরব জঙ্গলের মতো ছিল, হাজী সাহেব বললেন: এই জায়গাতে কি কেউ আসবে! যাক আলহামদুলিল্লাহ তাদের প্রস্তাবে তিনি রাজী হলেন। এবং তাঁর ও এলাকার অন্যান্যদের সহায়তায় মৌলভী ফিরুজ মিয়া চৌধুরী রহ. বিশ^বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসরণ ও অনুকরণে খাঁটি আলেম ও মুহাফিজ তৈরির মহান ব্রত নিয়ে ১৯৪৪ সালে মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন। অবশ্য শায়খ আব্দুল আযীয আতর মিয়া (বয়স ৯০) যিনি মাদ্রাসার প্রথম ভর্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের একজন, বর্তমানে মাদ্রাসার উস্তায, তাঁর দেওয়া তথ্যমতে এর আরো ২/৩ বছর পূর্ব থেকেই এটি মকতব হিসেবে চলে আসছিল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমামবাড়ী মাদ্রাসা এতদাঞ্চলের ইলমুল ওহীর শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে। র্শিক, বিদআত ও কুসংস্কারাচ্চন্ন সমাজে শিক্ষার আলো বিস্তার, সর্বোপরি তাহযীব-তামাদ্দুনের লালন ও বিকাশে জামিয়া অতন্দ্র প্রহরীর ভুমিকা পালন করছে।
“ইমামবাড়ি” নাম করনের ইতিহাস
নির্ভযোগ্য মুরুব্বিদের থেকে জানা গেছে যে, এ স্থানটির নাম ছিল “ইমাম বাড়াহ”এখানে একটি ঘর ছিল যেটিতে তা’জিয়া পালন করা হত, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মানুষ এগুলো থেকে ফিরে আসে তখন মুরুব্বিগণ এ জায়গার নাম দেন ইমামবাড়ি।
এ দ্বীনী দরসগাহ-এর প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যারা স্মরণীয় হয়ে আছেন তারা হলেন:
জনাব আলহাজ্ব আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী, আলহাজ্ব আব্দুর রহিম চৌধুরী, আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ চৌধুরী, শেখ ছানাওয়ার মিয়া, আলহাজ্ব আফসর মিয়া, কাজল মিয়া, আব্দুল জব্বার, আলহাজ্ব উসমান গণী, মুহাম্মদ সাজন খান, আলহাজ্ব মৌলদ হুসেন চৌধুরী, আলহাজ্ব তারা মিয়া চৌধুরী, আলহাজ্ব জহুর উদ্দীন চৌধুরী, মাও. আব্দুস সাত্তার, মাওলানা মুজাফ্ফর (গেদু মিয়া) প্রমূখ।
প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৪৪ থেকে ২ বছর মৌলভী ফিরুজ মিয়া রহ. ও অন্য দুজন নোয়াখালির হুজুর উর্দূ কায়দা ও অন্যান্য ইবতেদায়ী কিতাবাদি পড়াতেন। মাদ্রাসার প্রথম ভর্তী হওয়া সৌভাগ্যবান ছাত্ররা হলেন: শায়খে ইমামবাড়ী আল্লামা আব্দুল মুমিন রহ., শায়খ আব্দুল আযীয (আতর মিয়া) (তিনি বর্তমানে জামিয়ার উস্তাদ) মাওলানা জাফর আহমদ, মৌলভী আব্দুর রহমান, মৌলভী এখলাছ মিয়া, মৌলভী ওয়াযুদ্দীন, মৌলভী উপরি মিয়া, মো: কিতাব আলী, নাজামত উল্লাহ ।
অতপর হযরত মাওলানা ক্বারী মিছবাহুজ্জমান কদুপুরী সাহেবকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তিনি পান্দামা, করীমাসহ ইলমে ক্বেরাতের কিতাবাদি পাঠদান শুরু করেন। অতপর মাওলানা আঃ শহীদ সাহেব দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে আসলে তাকে মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি আরো কয়েকজন বিদগ্ধ আলেমকে উস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দেন। এবং পর্যায়ক্রমে মিযান, নাহবেমীর, হেদায়াতুন্নাহু, কাফিয়া ও শরহে জামী ইত্যাদি জামাত চালু করেন। তখন আরো যারা উস্তাদ হিসেবে ছিলেন তারা হলেন: মাওলানা মিছবাহুজ্জমান উমেদনগরী রহ., মাওলান আব্দুল বারী রহ., মাওলানা আব্দুল করিম রহ. ও মাওলানা আব্দুল হাই শায়খে বালিধারী রহ., মাও. আশরাফ আলী রহ. প্রমূখ।
জামিয়ার প্রথম পাকা ঘর নির্মান
ইমামবাড়ী বাজারের উত্তর পার্শ্বে এলাকার ৭ গ্রামের মানুষের ঈদগাহ ছিল। সেটির মুতাওয়াল্লী ছিলেন পুরানগাঁও গ্রামের হাজী আব্দুর রহমান সাহেব। ঈদগাহ পাকা করার জন্য ইট বানানো হয়েছিল। এক পর্যায়ে কোনো একটি কারণে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় এবং সেই ইট মাদ্রাসায় দেওয়া হয় এবং তখন থেকে ঈদের জামাত মাদ্রাসার মাঠেই পড়া হয়। সেই ইট দিয়ে মাদ্রাসার প্রথম পাকা ঘর বানানো হয়।
দাওরায়ে হাদীস চালু
১৯৭৪ সালে অত্র জামেয়ায় দাওরায়ে হাদীস চালু হয়। বুখারী শরীফের র্দস প্রদান করেন শায়খে ইমামবাড়ী আল্লামা আব্দুল মুমিন রহ., মুসলিম শরিফের র্দস দেন আল্লামা আব্দুর রহমান শায়খে ধুলিয়া রহ. আর তিরমিযী শরীফের র্দস প্রদান করতেন আল্লামা গোলাম কুদ্দুস সাহেব, বানিয়াচং, মুফতী আব্দুল কাইয়ুম দা.বা.ও তখন দাওরা জামাতে পড়াতেন। সে বছর হাদীসের র্দস সম্পন্ন করে যেসব ছাত্ররা দস্তারে ফযীলত বা পাগড়ি লাভ করেছিলেন তাদের কয়েকজন হলেন: মাওলানা আব্দুল হামিদ, ঘাটুয়া, মাওলানা মনসুর, ধুলিয়া, মাওলানা আব্দুল আলীম, গোজাখাইর, মাওলানা ইসমত উল্লাহ, নোয়াগাও, মাওলানা আব্দুল জলীল, নেত্রকোনা মাওলানা খলিলুর রহমান, বানিয়াচং, মাও. নুরুল ইসলাম, শেরপুর, মাওলানা খলিলুর রহমান, গুনই।
হিফজখানার সূচনা
১৯৯১ সালে মাদ্রাসার উত্তর পার্শে হাজী ছমরু মিয়া লন্ডনী সাহেবের অনুদানে হিফজখানার জন্য নতুন ভবন নির্মান হয় এবং সেখানে সম্পুর্ণ পৃথকভাবে হিফজ বিভাগ চালু হয়। অবশ্য এর আরো পূর্ব থেকেই অনাবাসিকভাবে হিফজ পড়াশুনা চলছিল। পরবর্তিতে ডা. আব্দুল খালেক সাহেবের অনুদানে মসজিদের দক্ষিণ পার্শে হিফজখানা জন্য নতুন ভবন নির্মান হয়।
জামিয়ার মহিলা শাখার সূচনা
১৯৯৬ সালে অত্র অঞ্চলের মেয়েদেরকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে জামিয়ার উত্তর পশ্চিম পার্শ্বে স্বতন্ত্র ২ একর ভ‚মিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় মহিলা শাখা। এতে ভ‚মি প্রদান করেন আলহাজ¦ মনাফ মিয়া ভবননির্মানে বড় অনুদান করেন আলহাজ¦ ছমরু মিয়া সাহেব, কালানজুরা।
বর্তমানে দেশের স্বনামধন্য আলেম উলামার সুষ্ঠ দিক-নির্দেশনা ও এলাকাবাসীর বদান্য অর্থানুক‚ল্যে পরিচালিত জামিয়ায় হিফজুল কুরআন শাখা ও নুরানী শিশু শ্রেণী থেকে সর্বোচ্চ জামাত দাওরায়ে হাদীস (টাইটেল) পর্যন্ত তা’লীম ও তরবিয়্যতের কাজ চলছে। আরবী, বাংলা, উর্দূ ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। আবাসিক ও অনাবাসিকসহ চার শতাধিক ছাত্র এবং তিন শতাধিক ছাত্রির সমন্বয়ে জামিয়ার উভয় শাখার কার্যক্রম সুচারুরূপে চালু রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রিদেরকে আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য এবং হালালভাবে জীবিকা উপার্জনের সহযোগিতার জন্য ২০২১ সালে কম্পিউটার ও সেলাই প্রশিক্ষণের আলাদা দুটি বিভাগ চালু করা হয়।
এই প্রতিষ্ঠানে যেসকল বুজুর্গানে দ্বীনের বিশেষ অবদান রয়েছে তারা হলেন: মাওলানা ক্বারী মিছবাহুজ্জমান রহ. মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা শায়খ আলাউদ্দীন, মাওলানা উসমান রহ., আল্লাম আব্দুর রহমান শায়খে ধুলিয়া রহ., মাওলানা রমিজ উদ্দীন রহ., মাওলানা গোলাম ক্দ্দুুস রহ., মাওলানা আব্দুল বারী রহ., মাওলানা আব্দুল করিম রহ., মাওলান শরীফ উদ্দীন রহ. খরকি, মাওলানা শায়খ শরফ উদ্দীন বেরাখালী রহ.। আল্লাহ তা’আলা প্রতিষ্ঠানটিকে কবুল করুন। আমীন!
লেখক: মাওলানা লুৎফুর রহমান খান, মুহতামিমে জামিয়া